
একবার চিন্তা করে দেখুন? পুরো বিশ্বে কেবল মাত্র একটাই টিভি থাকবে। যেখানে সবকটি টিভি চ্যানেল, সবধরণের খবর, বিনোদন, খেলাধুলা কিংবা যেকোন অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার; সবকিছুই দেখা যাবে। আর বর্তমানে সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যতম দুইটি প্রতিষ্ঠান ফেসবুক এবং ইউটিউব।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে। যা বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ৪৫.১২%। এই বিশাল স্মার্টফোন ব্যবহারকারী যতক্ষণ না টিভির সামনে থাকে, তার চাইতে অধিক সময়ই ব্যয় করে নিজের মোবাইলে।
আর তাই ২০১৭ সালেই ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ ঘোষণা দিয়েছিল ফেসবুকই হতে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিভি। অর্থাৎ বিশ্ব টিভি হতে যাচ্ছে ফেসবুক। অন্যভাবে বললে- টেলিভিশনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ফেসবুক।
তবে ২০১৭ সালে মার্ক জুকারবার্গ ঘোষণা দিলেও এই দৌড়ে একধাপ এগিয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যতম জায়ান্ট ইউটিউব। সেই ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল প্রথম ভিডিও (Me at the Zoo) দিয়ে যাত্রা শুরু ভিডিও শেয়ারিং এর সামাজিক মাধ্যম ইউটিউবের। বর্তমানে যা টেলিভিশনের ধারনায় পাল্টে দিয়েছে। আর তাই মানুষের এখন টেলিভিশন চ্যানেলের নাম মনে না থাকলেও ইউটিউব চ্যানেলের নাম ঠিকই মনে থাকে।
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, একবিংশ শতাব্দিতে তথ্য-প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় চমক কি? আমি বলবো ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। যা আমাদের চিন্তা, চেতনা এমনকি ক্সদনন্দিন জীবন যাপনের উপরও প্রভাব বিস্তার করছে। ফেসবুকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে- তারা চাইলেই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তার সামনে স্ক্রিনে যখন সব ধরণের নেগেটিভ পোস্ট কিংবা নেগেটিভ ভিডিও আসতে থাকবে তখন তার মধ্যে একটি নেগেটিভ মানসিকতার সৃষ্টি হবে। আর ঠিক একইভাবে পজিটিভ মানসিকতারও সৃষ্টি করতে পারবে ফেসবুক। ঠিক এরকমই একটি পরীক্ষা ২০১৫ সালে চালিয়েছিল ফেসবুক। আর ২০১৯ সালেই ফেসবুক ঘোষণা দিয়েছে- তারা মানুষের মনকে চাইলে পড়তে পারবে। ব্রেইনের নিউরন থেকে পাঠানো সিগন্যালকে ডেকোড করে তা লিখিত রূপ দেয়ার পক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তাই এখন শুধু চিন্তা করলেই হবে মুখে আর কিছুই বলা লাগবে না। তবে এ নিয়ে গবেষণা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষই টিভি দেখে কেবলমাত্র সরাসরি সম্প্রচারিত খেলাধুলা কিংবা সংবাদ দেখার জন্য। আর বিষয়টাও এখন অনেক সহজ করে দিয়েছে ফেসবুক-ইউটিউব। এক সময় কোন অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার মানেই ছিল বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। প্রয়োজন হতো দামী দামী ইনস্ট্রুমেন্টের। আবার এসব পরিচালনার জন্য লাগতো পর্যাপ্ত লোকবল। অথচ এখন যে কেউ চাইলেই যে কোন স্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার স্মার্টফোন দিয়ে লাইভ দিতে পারেন।
বিশ্বে এখন ছোট-বড় সবধরনের মিডিয়ারাই ফেসবুক এবং ইউটিউব নির্ভর। প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে দৈনিক সংবাদপত্র পর্যন্ত তাদের নিজেদের অনলাইন পোর্টালের পাশাপাশি কন্টেন্ট দিচ্ছে নিজ নিজ ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে। তাই অতি কঠিন বাস্তবতা হলো- একসময় হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে ছাপানো পত্রিকা এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন। যার প্রভাব ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সবকটি সংবাদপত্রই ইতোমধ্যে অনলাইন পোর্টাল চালু করেছে। ১২০ বছরের পুরনো ব্রিটেনের ‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট’ তাদের ছাপানো সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে অনেক আগেই। পাশাপাশি পত্রিকাগুলোও এখন জোর দিচ্ছে ভিডিও কন্টেন্টের উপর। আমাদের দেশেও প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকালসহ অনেক দৈনিক পত্রিকাও এখন তাদের ভিডিও কন্টেন্ট দিচ্ছে নিজ নিজ ফেসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেলে।
সবচেয়ে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন সংবাদ মাধ্যমের জন্য সংবাদের অন্যতম উৎসে পরিণত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ভাইরাল তাই দেখাতে বাধ্য হচ্ছে নিউজ চ্যানেলগুলো, চাপাতে হচ্ছে পত্রিকায়। অর্থাৎ আগামীকাল পত্রিকায় কি চাপবে তা এর আগের দিনই নির্ধারণ করে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া।
এখন বিনোদনের অন্যতম খোরাক এই সোশ্যাল মিডিয়া। নাটক, সিনেমা আগে টিভিতে প্রচারিত হলেও বর্তমানে টেলিভিশনের বড় একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে অনলাইন মাধ্যম। একসময় যেখানে টেলিভিশনের জন্য নির্মাতারা একাধিক নাটক নির্মাণ করতেন, এখন তারাই নাটক নির্মাণ করছেন অনলাইনের জন্য। অনলাইনের জন্য নির্মিত নাটকগুলোতে অর্থলগ্নি করছে বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এইসব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইউটিউব চ্যানেল বা ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটে প্রচার করছে নাটকগুলো। নির্মাণ করা হচ্ছে ওয়েব সিরিজ। তাই চলচ্চিত্র কিংবা নাটক ইন্ডাস্ট্রিও এখন সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর।
বর্তমানে টিভি চ্যানেলগুলোর অন্যতম খাবার যোগানদাতা বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠান তথা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। যারা নিজেরাও এখন ঝুঁকছে ফেসবুক এবং ইউটিউবের দিকে। নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিচ্ছে গুগলে এবং ফেসবুকে। আবার নিজেদের পণ্যের প্রচার করছে নিজেদের ফেসবুক পেইজেই। একসময় বড় বড় টিভিসি বানিয়ে তা প্রচার করা হতো স্যাটেলাইট টেলিভিশনে আর এখন তা দিয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেইজ কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে। আর একটু ভালো টিভিসি হলেই তা হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি ভাইরাল। শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলোও এখন অর্থলগ্নি করছে অনলাইনে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে।
তাহলে টিভির ব্যবহার কি বন্ধ হয়ে যাবে? এক সাথে পরিবারের সাথে বসে মানুষ কি টিভি দেখবে না? উত্তর: অবশ্যই না, টিভির ব্যবহার বন্ধ হবে না। মানুষ এখন স্মার্ট টিভি ব্যবহার শুরু করবে। আর তাই দেশীয় থেকে শুরু করে বিদেশি টিভি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তৈরি করছে স্মার্ট টিভি। টিভি এখন আর টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখার যন্ত্র নয়। টিভিতেই এখন মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে ইউটিউব, ফেসবুক কিংবা নেটফ্লিক্সের মতো অ্যাপগুলো ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো ভিডিও দেখবে।
সর্বশেষ তথ্যপ্রযুক্তির এই ধারায় যুক্ত হয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শুধুমাত্র শিল্পায়নেই নয়, সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এর প্রভাব শুরু হয়েছে। ChatGPT দিয়ে অনায়াসেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এখন স্ক্রিপ্টিং করা যাচ্ছে, ভয়েস এআই দিয়ে দেয়া হচ্ছে ভয়েস ওভার। এমনকি সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে এআই নিউজ প্রেজেন্টার দিয়ে সংবাদ পাঠ। তাই বলা চলে, অদূর ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তা হয়তো এখনো সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে? নাকি কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি? সেটা নিয়েও এখন আলোচনা হচ্ছে। তবে এটা সত্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক চমক নিয়ে আসবে এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স।